আজ ৩০ জুন, শহীদ আরমান দিবস। ১৯৯৪ সালের এই দিনে কিশোরগঞ্জ শহরের রাজপথে ইসলামী মূল্যবোধ রক্ষার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন স্কুলপড়ুয়া তরুণ আরমান। দেশের নাস্তিকতা ও ধর্মবিদ্বেষের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গকারী এই কিশোর আজো প্রেরণার প্রতীক হয়ে আছেন হাজারো মানুষের হৃদয়ে।
৩১ বছর আগের সেই দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। লেখিকা তাসলিমা নাসরিনের ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্য ও লেখনির প্রতিবাদে তৌহিদি জনতা সারা দেশে হরতালের ডাক দেয়। সারাদেশের মতো ধর্মপ্রাণ মানুষ অধ্যুষিত কিশোরগঞ্জেও পালিত হয় নজিরবিহীন হরতাল। সকাল থেকে মিছিল-মহাসমাবেশে মুখর হয়ে ওঠে শহরের প্রতিটি মোড়।
দুপুরের দিকে শহরের গৌরাঙ্গবাজার এলাকায় এক মিছিলে হামলা চালায় পুলিশ। নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন কিশোর আরমান। সেই তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় কিশোরগঞ্জ শহর। একই ঘটনায় আহত হন জামিয়া ইমদাদিয়ার ছাত্র মাওলানা গাজী আশরাফ আলীসহ অনেকেই।
শহীদ আরমান কিশোরগঞ্জের পুরান থানা এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তিনি আজিম উদ্দিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং শহীদি মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন। ইসলামী ছাত্র মজলিসের সদস্য হিসেবে ধর্মীয় ভাবনায় গড়ে ওঠা এই কিশোর শুরু থেকেই ছিলেন সক্রিয়। তার শহীদ হওয়ার আগের দিনও তিনি শিক্ষক মাওলানা সালাহুদ্দিনের কাছে শহীদ হওয়া বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন—নাস্তিক-মুরতাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে মৃত্যু হলে শহীদ হওয়া যাবে কিনা। সেই প্রশ্ন ও উত্তরই যেন তাকে প্রেরণা দিয়েছিল চূড়ান্ত আত্মত্যাগের পথে।
সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং আরমানের সঙ্গী মাওলানা গাজী আশরাফ আলী বলেন,
“আরমান বলল—ইসমাঈল হুজুরকে পুলিশ মারছে, চল দেইখা আসি। আমরা জনতা ব্যাংকের সামনে পৌঁছাতেই গুলির শব্দ। কিছু বুঝে উঠার আগেই আরমান পড়ে গেলো, আমি নিজেও গুলিবিদ্ধ হই। পরে জানতে পারি, আরমান আর নেই…”
পরদিন শহীদ আরমানের লাশ নিয়ে শহরের প্রধান সড়কে বিশাল শোকমিছিল বের হয়। ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় তার জানাজা, যেখানে কিশোরগঞ্জসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে আলেম-উলামা ও হাজারো মানুষ অংশ নেন। পরে শহীদি মসজিদের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়।
জনগণের দাবির মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করলেও, হত্যার বিচার আজও আলোর মুখ দেখেনি। শহীদ আরমানের মৃত্যু আজো হয়ে আছে এক প্রশ্নবিদ্ধ ইতিহাস—যেখানে আত্মত্যাগ আছে, কিন্তু বিচার নেই।
তিন দশক পেরিয়ে গেলেও শহীদ আরমানকে স্মরণ করেন ধর্মপ্রাণ মানুষ, তাঁর আত্মত্যাগ নতুন প্রজন্মকে দীনের পথে আত্মনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে। এদেশে ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্ব যতদিন থাকবে, শহীদ আরমান ততদিন এক অনন্ত প্রেরণার নাম হয়ে থাকবেন।
