দীর্ঘ ৩৭ বছর পর আবারও বাংলাদেশ পেয়েছে ইংলিশ চ্যানেল জয় করার বিরল গৌরব। কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার গর্বিত সন্তান, সারা দেশের অহংকার নাজমুল হক হিমেল তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে।
গত ২৯ জুলাই (মঙ্গলবার) বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে এবং ইংল্যান্ডের সময় রাত ২টা ৩০ মিনিটে শুরু হয় এই অভিযান, যা শেষ হয় একই দিনে সন্ধ্যায়। প্রায় ১২ ঘণ্টা ১০ মিনিট সময় নিয়ে চ্যানেলটি সফলভাবে পাড়ি দেন তিনি।
ইংলিশ চ্যানেল, যা আটলান্টিক মহাসাগরের অংশ এবং ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত বরফশীতল পানির এক চরম প্রতিকূল জলপথ, তা জয় করে হিমেল আবারও প্রমাণ করলেন বাংলাদেশি সাঁতারুদের সম্ভাবনা।
শৈশব থেকেই সাঁতারের প্রতি ভালোবাসা
হিমেলের সাঁতারে হাতেখড়ি ১৯৯৭ সালে, তাঁর বাবা আবুল হাসেমের মাধ্যমে। আবুল হাসেম আশির দশকের জাতীয় সাঁতারু, বর্তমানে নিকলী সুইমিং ক্লাবের কোচ এবং জাতীয় সুইমিং ফেডারেশনের সাবেক সদস্য।
চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় হিমেলের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে সাবেক সাঁতারু মো. সোলায়মানের অধীনে। এরপর তিন বছর জাপানি ও পরে চীনা কোচের অধীনে আরও সাত বছর প্রশিক্ষণ নেন তিনি।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য
১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে জাতীয় বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় ২০টি স্বর্ণ ও ১৫টি রৌপ্য পদক জিতেছেন হিমেল। ২০০৬ সালে ‘সেরা সাঁতারু’ নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৬-২০০৮ সময়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ৫টি স্বর্ণ ও ৪টি রৌপ্য জয়ের পাশাপাশি গড়েন ৬টি জাতীয় রেকর্ড।
২০০৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ইন্দো-বাংলা গেমসে এক স্বর্ণ ও দুই রৌপ্য পদক জিতে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেন।
চীনে উচ্চশিক্ষা ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা
বিকেএসপি থেকে এসএসসি (২০০৬) ও এইচএসসি (২০০৮) সম্পন্ন করে উচ্চশিক্ষার জন্য চীনে পাড়ি জমান। বেইজিং স্পোর্টস ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৯-২০১৩ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক এবং ২০১৩-২০১৬ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন শারীরিক শিক্ষায়।
এই সময় ‘অল বেইজিং ইন্টারন্যাশনাল ফরেন স্টুডেন্টস চ্যাম্পিয়নশিপ’-এ চ্যাম্পিয়ন হন (২০১২), কুনমিং ওপেন ওয়াটার চ্যাম্পিয়নশিপে (২০১২ ও ২০১৩) জেতেন এক স্বর্ণ ও এক রৌপ্য।
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি—এক সাহসী যাত্রা
বিশ্বের অন্যতম কঠিন জলপথ ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার জন্য বিগত কয়েক বছর ধরে হিমেল কঠোর অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বাংলাদেশের উষ্ণ আবহাওয়ায় ঠান্ডা পানির অভাবে বরফ তৈরির ফ্যাক্টরিতে আইসবাথে শরীরিক সহ্যক্ষমতা বাড়ানোর চর্চা করেছেন। প্রতিদিন সোয়াইজনী নদীতে সাঁতার কেটে ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার দূরত্ব অনুশীলন করেন। পাশাপাশি শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ড্রামের বরফ পানিতে ডুবে অনুশীলন চালিয়ে গেছেন নিয়মিত।
বাংলাদেশের গর্ব
নাজমুল হক হিমেলের এই অর্জন শুধু ব্যক্তি নয়, বরং পুরো দেশের জন্য এক গৌরবময় অধ্যায়। ৩৭ বছর পর বাংলাদেশ আবারও ইংলিশ চ্যানেল জয় করল—এই কৃতিত্বে হিমেল হয়ে উঠেছেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা।
