ঢাকাসোমবার , ২৩ জুন ২০২৫
  1. অষ্টগ্রাম
  2. ইটনা
  3. কটিয়াদী
  4. করিমগঞ্জ
  5. কুলিয়ারচর
  6. কৃষি
  7. খেলাধুলা
  8. তাড়াইল
  9. নিকলি
  10. পর্যটন
  11. পাকুন্দিয়া
  12. বাজিতপুর
  13. বিনোদন
  14. ভৈরব
  15. ভোটের বাঁশি
আজকের সর্বশেষ সবখবর

নরসুন্দার বুকে বিস্ময়কর বিশ্বাসের মিনার—পাগলা মসজিদ: দানের টাকা প্রায় শতকোটি

প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
জুন ২৩, ২০২৫ ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

নরসুন্দা নদীর বুকে জেগে ওঠা একটি টিলামত ভূখণ্ড—সেখানেই একদিন বসবাস করতেন এক সাধক। ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষ তার কাছে ছুটে যেতেন দুঃখ-কষ্ট লাঘবের আশায়। সেই সাধকের উপাসনালয় আজ পরিণত হয়েছে দেশের অন্যতম রহস্যময়, জনপ্রিয় ও দানবহুল ধর্মীয় স্থানে—কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ। এমনটিই জনশ্রুতি রয়েছে।

নরসুন্দা নদীর চরজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই মসজিদ আজ আর শুধু একটি উপাসনালয় নয়, এটি এখন শত শত মানুষের বিশ্বাস, ভক্তি আর মানতের এক অনন্য প্রতীক। এখানে দান হিসেবে আসে শুধু নগদ অর্থ নয়, আসে সোনা, রুপা, গরু-মহিষ, ছাগল, হাঁস-মুরগি এমনকি বেনামি চিঠি আর চোখের জলের আকুতি।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, মসনদে আলা ঈসা খাঁর বংশধর হয়বতনগরের জমিদার জিলকদর খান ছিলেন এক পরম ধর্মভক্ত সাধক। তার বসবাস ছিল হারুয়া ও রাখুয়াইলের মাঝখানে, নরসুন্দা নদীর বুক চিরে জেগে ওঠা এক টিলায়। এই স্থানটি পরবর্তীতে হয়ে ওঠে পাগলা মসজিদ।
সেই সময় থেকেই মসজিদটির প্রতি মানুষের অগাধ ভক্তি। যুগের পর যুগ ধরে এখানে আসা মানুষেরা বিশ্বাস করে, মানত করলে মনের বাসনা পূরণ হয়। এই বিশ্বাস এখনো অটুট, বরং সময়ের সঙ্গে বেড়েছে ভক্তি, বেড়েছে দানের পরিমাণ।

প্রতি তিন মাস অন্তর মসজিদের দানবাক্সগুলো খোলা হয়। সর্বশেষ গত ১২ এপ্রিল, চার মাস ১১ দিন পর যখন ১১টি দানবাক্স খোলা হয়, তখন পাওয়া যায় মসজিদের ইতিহাসে রেকর্ড ৯ কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার ৬৮৭ টাকা!
এছাড়া পাওয়া যায় সোনা-রুপার অলংকার, বিদেশি মুদ্রা, এমনকি নানা আকৃতির মূল্যবান উপঢৌকন।

এ গণনায় অংশ নেন ১৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, রূপালী ব্যাংকের ৮০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং মসজিদ কমপ্লেক্স মাদ্রাসার ২৫৭ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দানবাক্সের অর্থ ব্যাংকে রাখা হয় নিয়মিত। বর্তমানে সেই সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ কোটি ৯৩ লাখ ৫৪ হাজার ২৬৩ টাকা

শুধু টাকা বা গহনা নয়, মানতের অংশ হিসেবে এখানে নিয়মিত আসে গরু-মহিষ, হাঁস-মুরগি, এমনকি ভেড়া-ছাগল। এ ছাড়া প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের দিন মসজিদজুড়ে দেখা যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজার হাজার মানতদাতার ঢল।
তাদের অনেকেই রেখে যান চিরকুট বা খাম—যেখানে থাকে পরিবারের সুস্থতা, সন্তানের ভবিষ্যৎ, কিংবা ব্যক্তিগত সংকট থেকে মুক্তির আকুতি।

বর্তমানে মসজিদের দানে গড়ে তোলা হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক মানের ইসলামিক কমপ্লেক্স। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন ৩০ হাজার মুসল্লি
মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, আবাসন, লাইব্রেরি, সম্মেলন কেন্দ্র, এবং ধর্মীয় প্রশিক্ষণকেন্দ্র মিলিয়ে হবে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক সেন্টার।

এ প্রসঙ্গে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফৌজিয়া খান জানান,
পাগলা মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, এটি সমাজকল্যাণ, শিক্ষা, দানবিনিয়োগ এবং মানবিকতার এক মহান প্রতিষ্ঠান। আমরা এটি আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

দানবাক্সের অর্থ পরিচালনা করে একটি নিরপেক্ষ পরিচালনা কমিটি—যার নেতৃত্বে রয়েছেন জেলা প্রশাসক, পৌরসভা এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।
এই তহবিল থেকে চালানো হয়, মসজিদ ও মাদ্রাসার সকল ব্যয়, এতিমখানার পরিচালনা ও শিক্ষার্থীদের ভরণপোষণ, জেলার বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় অনুদান, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, অসহায় ও দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা সহায়তা।

আজকের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে যেখানে ধর্মীয় চর্চা ক্রমশই নির্জীব হয়ে পড়ছে, সেখানে কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদ যেন এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ।
এখানে ভিড় করেন শুধু মুসলমান নয়, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও। কারণ, এখানে মানুষ আসে হৃদয়ের দুঃখ বয়ে—ভরসা নিয়ে, ফিরে যায় শান্তি ও আশাবাদ নিয়ে।

পাগলা মসজিদ তাই কেবল একটি স্থাপনা নয়—এটি সময়ের বাঁকে বাঁকে বয়ে চলা বিশ্বাসের ইতিহাস, আস্থার ঠিকানা এবং মানবিকতার নিরব বার্তা।