ঢাকাসোমবার , ২৩ জুন ২০২৫
  1. অষ্টগ্রাম
  2. ইটনা
  3. কটিয়াদী
  4. করিমগঞ্জ
  5. কুলিয়ারচর
  6. কৃষি
  7. খেলাধুলা
  8. তাড়াইল
  9. নিকলি
  10. পর্যটন
  11. পাকুন্দিয়া
  12. বাজিতপুর
  13. বিনোদন
  14. ভৈরব
  15. ভোটের বাঁশি
আজকের সর্বশেষ সবখবর

নেই ভাত, নেই ভরসা: সাপ-সাপুড়ের পেশায় ভরসা হারাচ্ছে ভৈরবের বেদে পল্লী

প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
জুন ২৩, ২০২৫ ২:০৭ অপরাহ্ণ
Link Copied!

বেদেদের বাশঁ-টিনের খুপড়িঁ ঘরে মিটবে কবে খুদার জ্বালা ?

কিশোরগঞ্জের ভৈরবের বেদে পল্লীতে ৩৫টি মুসলিম পরিবারের বসবাস। শিশু-কিশোরসহ  এ পল্লীতে অন্তত ৩শতাধীক নারী-পুরুষের জীবনকাল চলছে বড্ড বেশি মানবেতরভাবে। বর্তমান আধুনিক যুগে এসে চরম দুর্দিন পোহাতে হচ্ছে এ পল্লীর বাসিন্দাদের। সাথে ভর করেছে  সুপেয় খাবার পানি ও স্যানিট্যারি লেট্রিনের অভাবে বাড়তি ভোগান্তি! ফলে মাত্রা বেড়েছে জন-জীবনে চরম দুর্ভোগের। বর্তমান আধুনিক সময়ে সাপ-সাপুড়িদের চিরচেনা সাপের খেলা দেখানো বা তাবিজ-কবজ বিক্রির পেশায় ভাটা পড়ায় চরম অর্থকষ্টে দিনপাড় করছেন এ পল্লীর বাসিন্দারা। বছরের বিশেষ বিশেষ দিনেও পরিবারের ছোট্ট অবুঝ শিশু-বাচ্চাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারেন না দরিদ্র বাবা-মায়েরা। এমনকি মুসলমানদের সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন ঈদেও নতুন জামা-কাপুড় পড়তে না পারার আক্ষেপে মলিন থাকে এ পল্লীর প্রতিটি ছোট্ট মিমুর মুখ। অতীতের ন্যায় বেদেনীরা এখন আর সভ্য সমাজের তেমন সাড়া পান না। এদিকে স্থায়ী বাসিন্দা না হওয়ায় এসব হতদরিদ্রদের কপালে কখনই জুটে না সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধাও। সবমিলিয়ে চরম অর্থকষ্টে জীবিকা নির্বাহে বছরের পর বছর এক মানবেতর সংগ্রাম করে আসছেন ভৈরব বেদে পল্লীর হত-দরিদ্র ৩শতাধীক মানুষ।

পদ্মপাড়ে নদী ভাঙ্গনের স্বীকার হয়ে ভৈরব-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়ক সংলগ্ন (হাইওয়ে থানার পেছনে) প্রায় একযুগ আগে বেদে স¤প্রদায়ের কয়েকটি পরিবার বসবাস শুরু করে। সময়ের ব্যবধানে বর্তমানে এ পল্লীর ৩৫টি পরিবারে শিশু-কিশোরসহ অন্তত ৩শতাধিক লোক বসবাস করছেন। এদের সবাই মুসলিম সম্প্রদায়ের। মুন্সিগঞ্জ ও বিক্রমপুরের পদ্মাপাড়ে নদী ভাঙ্গনের স্বীকার হয়ে ভিটা-মাটি সব হাড়িয়ে এখানে আশ্রয় নেন তারা। স্থানীয় নামে পরিচিত ভৈরবের সাতমুখী বিলের টিলায় খুপড়ি ঘর বানিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস শুরু করেন এ পল্লীর হত-দরিদ্র মানুষেরা। নিজেদের থাকার জন্য তারা নিজেরাই বানিয়ে নেন বাঁশ আর পলিথিনের সমন্বয়ে ঠুনকো খুপড়ি ঘর। দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও এসব পরিবার গুলোতে অভাব-অনটনের চিত্র পাল্টায়নি একবিন্দুও বরং বেড়েছে। কারণ বর্তমান আধুনিক যুগে তাবিজ-কবজে ভরসা করেন এমন মানুষ খুজে পাওয়া দুষ্কর। গ্রাম থেকে শহরে, ইট-পাথরের ইমারতে নির্মিত দালান-কঠোয় অত্যাধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি স্বম্বলিত হাসপাতাল আর অগণিত ক্লিনিকের ভীরে বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছে বেদে সম্প্রদায়ের তাবিজ-কবজ বা ঝাড়ফোঁকের চিকিৎসা পদ্ধতি। ফলে তিন বেলা খাবারের যোগান দিতে এখন আর পূর্ব-পুরুষদের সাপ-সাপুরের পেশায় খুব একটা ভরসা রাখতে পারছেন এখানকার বাসিন্দারা। ফলশ্রæতিতে ভীন্ন পেশায় ঝুকছেন এ পল্লীর প্রতিটি পরিবারের উপার্জন-ক্ষম ব্যক্তিরা। বেদে পল্লীর এমন দুঃখ-কষ্ট লাঘবে এখন এ-পল্লীর হত-দরিদ্রর মানুষেরা বিত্তবানদের সুনজর কামনা কওে দুর্দীনের অবসান চান। বর্তমান সময়ে বেদে স¤প্রদায়ের উপার্জনে ভাটা পড়ায়, সারা বছরই এসব পরিবার গুলোতে লেগে থাকে চরম অর্থ-কষ্ট। অর্ধাহারে-অনাহারে দিনের পর দিন কেটে গেলেও এ পল্লীর প্রতিটি খুপড়িঁ ঘরগুলোতে অভাব অনটনের নিদারুন চিত্র দেখা যায়। সম্প্রতি সময়ে তাবিজ-কবজ বিক্রি বা ঝাড়ফুঁকের কাজ তুলনামূলক কমে যাওয়ায়, কমে গেছে তাদের সিংহভাগ আয়ের অংশও।  সবমিলিয়ে এসব ভাসমান মানুষদের সেই চিরচেনা অভাব-অনটনের মাত্রা বেড়ে গেছে আরো কিছুটা! রাত-দিন তীব্র খাবার সংকটে খেয়ে- না খেয়ে বর্তমানে কোনো রকমভাবে দি চলে যাচ্ছে এ বেদেপল্লীর মুসলিম পরিবারের মানুষ গুলোর।

পল্লীতে একটি মাদ্রারাসও রয়েছে। মাদ্রাসাটিতে ছাত্রের সংখ্যা ৬০জন। তাদের লেখাপড়ার খরচ তাদের বাবা-মায়েরা নিজেরাই বহন করেন। তবে খাবার খরচ কিংবা আনুসাঙ্গিক সংসারের অন্যান্য খরচ মেটানোর পর সন্তানের পড়াশোনার খরচ বহন করাও যেন কাটার উপরে মরার ঘাঁ। এদিকে দামি কাপড় পড়ে ভ্যানে চড়ে কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার উচ্চাকাঙ্খা না থাকলেও মাদ্রাসার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আরবি শেখার প্রতি ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষা করা যায়। বিদ্যুৎ বিলসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অর্থ যোগানেও হিমশিম খেতে হচ্ছে মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের।

পল্লীর বাসিন্দা চামেলী বেগম জানান, “বড়লোকদের লাগান আমাগো বড় বড় শখ নাইগা। তয় পুলা-মাইয়া লইয়া তিন বেলা না অইলেও অন্তত দুই বেলা পেটের খিদা মিটাইবার পারলেই আমরা বাপ-মায়েরা মনে শান্তি পাই। কিন্তু দিন দিন আমাগো অবস্থা খারাপের দিগেই আগাইতাছে।”

আরেক বাসিন্দা শুক্কর আলী জানান, “এখন আর আমাগো কেউ বিশ্বাস করে না। আমাগো চিকিৎসা নাকি “ভুয়া”। তাই গেরাম এলাকাতে গেলে পড়ে আমাগো দেখলে মানুষ কত ব্যঙ্গ করে! অনেকে তো সাপের ডরে আমাগো বাড়ির আঙ্গিনা থাইকাই তাড়াইয়া দেই।”

পল্লীর সরদার আতাউর রহমান বলেন, “পানির কলে ভেইন্নালা( সকাল) পানি থাকলে বাইট্টালা (বিকেল) পানি থাকে না। এ নিয়া ভীষণ বেকায়দায় আছি। সরকারের যদি সুযোগ থাকে তয় আমাগো লাইগা যেন দুইড্ডা (দুইটি) টয়লেট নির্মাণ কইরা দেয়। জানতে পারছি আমরা স্থানীয় নাগরিক হইনাই বইলা আমাগো সরকারি ত্রাণ-সামগ্রী দেওন যায়না। এর লাইগা আমগো পাশে যদি আমনেরা বড়লোকেরা একটু দয়ার নজরে দেখতেন আমাগোর সুদিন ফিরা আইতো।”

প্রতিবেদন তৈরির সময় দেখা হয় দু’জন সেবাভোগী নারীর সাথে। একজনের নাম জুলেখা বেগম, অপরজন সড়লা বেগম।

জুলেখা বলেন, “আমরা কালিকাপ্রসাদ থেকে আসছি। আমাদের বাড়িরর অনেকেই এখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে উপকার পেয়েছে। তবে আমরা এ নিয়ে দুইবার এসেছি। প্রতি মাসে দুইবার আসতে বলা হয়েছে। কেমন টাকা খরচা হয় এমন প্রশ্নের উত্তরে জুলেখা জানান, বেদেনীদের তাবিজ কবজের মাধ্যমে চিকিৎসা বা ঝাড়ফোকেঁর তেমন খরচ নেই। অল্প টাকাতেই তারা মানুষের উপকার করার চেষ্টা করে। এখন পর্যন্ত আমরা মোটামোটি সন্তোষজনক সেবা পেয়েছি।”

অপরজন সড়লা বেগমের কাছে বেদেনীদের চিকিৎসা পদ্ধতি বৈধ-অবৈধের বিষয়ে প্রশ্ন রাখলে, সে জানান- “বেদেনীদের তাবিজ-কবজে আসলে কতটুকু রোগমুক্তি মেলে সে বিষয়ে আমার অভিগজ্ঞতা কম। আসপাশের লোকমুখে শুনে কিছুটা বিশ্বস্থ মনে হওয়ায় এখানে এসেছি। এছাড়াও আল্লাহ’পাকের পবিত্র কুরআনের আয়াত সম্বলিত কোনো কিছুকে আমি অবৈধ বলতে রাজি নই।”

জুলেখা ও সড়লা বেগমের সাথে আলাপ-চারিতার এক ফাকে দেখা হয় সিএনজি চালক জমির উদ্দিনের সাথে। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, “প্রায় সময়ই বেদে পল্লীতে রোগী নিয়ে আসি। আল্লাহ’র রহমতে আমি নিজেও এই পল্লীর চিকিৎসা পাইয়া সুস্থ হইছি। বাইদ্দান্নীদের (বেদেনী) দুঃখ-কষ্টের কথা শুনলে আমাদেরও খারাপ লাগে।  কিন্তু আমরা সেই অর্থে মধ্যবিত্তও না, নিতান্তই নিম্ন আয়ের মানুষ। আমাদের পক্ষে আসলে তাদেরকে সহযোগিতা করার সম্ভব হয় না। তাই সমাজের যারা ধনী মানুষেরা আছেন তারা যেন এই পল্লীর দিকে একটু সুনজর দেন, এটা আমার ব্যক্তিগত অনুরোধ।”

ভৈরব পৌর কর্তৃপক্ষের নির্বাহি প্রকৌশলী ওমর ফারুক বলেন, “সরকারিভাবে তাদেরকে উপকার করতে না পারলেও আমরা সরকারি কর্মকর্তারা চাই- সমাজের যারা বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গরা রয়েছেন তারা যেন নিজেদের ভোগ-বিলাশের জীবন থেকে ক্ষাণিকটা এ পল্লীর এসব গরীব মানুষদের সাথে ভাগ করে নেয়। আমার বিশ্বাস তাহলে কিছুটা হলেও খাবার সংকট কিংবা সুপেয় পানি ও পাকা টয়লেটের দুর্ভোগ কেটে যাবে। এছাড়াও এমন দৃষ্টিকোণকে সম্মাণ জানিয়ে তিনি আরো বলেন, মানব সেবাই পরম ধর্ম- সমাজের শিল্পপতি বা ধর্নাঢ্য ব্যক্তিরা এ নীতি অবলম্বন করে সহযোগিতার হাত বাড়ালে বেদে পল্লীতে মানুষের কষ্ট কমে আসবে।”

বেদে পল্লীর এসব হত-দরিদ্র মানুষদের দুর্ভোগ লাঘবে সরকারি সহযোগিতার কোনো ধরনের সুযোগ রয়েছে কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে ভৈরব উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা ও নির্বাহি ম্যাজিষ্ট্রেট শবনম শারমিন জানান, “বেদে পল্লীর বাসিন্দারা ভাসমান হওয়ায় সব সময় তাদেরকে সরকারি সহযোগিতার আওতায় নিয়ে আসার সুযোগ হয় না। তবে উপজেলা প্রশাসন এবং পৌর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ত্রাণ তহবিল থেকে বছরের প্রতি ঈদে তাদের মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করা হয়। এরই ধারবাহিকতায় গত রমজানে কিছু শাড়ি কাপড় এবং সবশেষ কোরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে বেদে পল্লীতে পর্যাপ্ত চাল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও আগামী দিনেও তাদের পাশে দাড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে সরকারি ত্রাণ- সহযোগিতা প্রদানের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে ।”

ঐতিহ্যগত পেশা বদলে যাওয়া, আধুনিক সমাজে স্থান না পাওয়া আর রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের অভাবে সরকারি সহযোগিতা থেকেও বঞ্চিত—ভৈরবের বেদে পল্লীর মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি যেন চরম অবহেলার প্রতীক। বাঁশ-টিনের খুপড়িঘরে ঠাঁই নেওয়া তিন শতাধিক মানুষ আজও পেট ভরে একবেলা খেতে পারেন না, শিশুদের মুখে নেই ঈদের খুশির হাসি, নেই নিরাপদ পানি বা শৌচাগারের মতো মৌলিক সুবিধাও।
চিকিৎসা দেয়ার ক্ষমতা থাকলেও সমাজ তাদেরকে ‘ভুয়া’ বলেই তুচ্ছ করে। তারা আজ যেন রাষ্ট্রের বুকে এক অদৃশ্য জনগোষ্ঠী—যাদের না আছে নাগরিক অধিকার, না আছে সম্মান।
অথচ এদের শিশুদের চোখেও থাকে স্বপ্ন, বড়দের বুকেও জমে ব্যথা। তবু তিনবেলার খাবার না জুটলেও কেউ সহানুভূতির পরিবর্তে এগিয়ে আসে না দায়িত্ব নিয়ে।
তাই আজ প্রশ্ন—কবে জুটবে তিন বেলা খাবার? কবে আসবে ঈদের দিনে নতুন জামা? আর কবে নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে ভৈরবের বেদে পল্লীর মানুষগুলো?

তাদের ঈদ বা কোন উৎসব আসে না নতুন জামার খুশি নিয়ে—আসে খালি পেটে আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দীর্ঘশ্বাস বয়ে।

## হৃদয় আজাদ, ভৈরব ##