তোফায়েল আহমেদ: জারী, সারী, ভাটিয়ালী লোক কাহিনীর গান/ ও ভাই কিচ্ছা কথার গান/ জানতে হইলে কিশোরগঞ্জে একবার ঘুইরা যান।
বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও- বলছি কিশোরগঞ্জের হাওরের কথা। হাওর-নদী ও উজান-ভাটির মিলন যে জেলায় সেটি হলো কিশোরগঞ্জ। বছরের দুই ঋতুর দুই সৌন্দর্যের দেখা মিলবে কিশোরগঞ্জর হাওরে। ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম এ তিনটি উপজেলা মূলত এ জেলার মূল হাওর। এছাড়া নিকলী, করিমগঞ্জ, বাজিতপুর, কুলিয়ারচর ও তাড়াইল উপজেলা আংশিক হাওর নিয়ে গঠিত। এখন বর্ষকাল কিশোরগঞ্জের হাওরের যতদূর আপনার দৃষ্টি সীমানা ঠিক ততটুকু জুড়েই শুধু পানি আর পানি। হাওরের কিছু দূর পর পর স্থানীয়দের এক একটি গ্রামকে মনে হবে যেনো ছোট ছোট নৌকা। চারদিকে পানি মাঝখানে জনপদ। দিগন্তজোড়া পানি আর মানুষের এ বন্ধন আপনার যান্ত্রিক জীবনে কিছুটা প্রশান্তি এনে দিবেই।
তবে শীতকালে বা শুকনো মৌসুমে এ জনপদের চিত্র ভিন্ন। বর্ষার দৃষ্টি সীমানায় যেখানে শুধুই পানি আর পানি সেখানে শুকেনো মৌসুমে যতদূর চোখ যাবে ততদূরই শুধু সবুজ আর সবুজ। মনে হবে সৃষ্টিকর্তা যেনো আপনার জন্যই সবুজ গালিচার দিগন্তজোড়া মাঠ তৈরী করে রেখেছে। হাওরের বৈচিত্রতা একেক ঋতুতে একেক রকম। শীতে সবুজ, চৈত্র-বৈশাখে সোনালী ধানের রংয়ে চারদিক সোনালী আকার ও বর্ষায় শুধু পানি আর পানি। জৈষ্ঠ্যের শেষ দিকে মূলত হাওরে পানি আসা শুরু হয়। আষাঢ়ে হাওর ফিরে পায় তার পূর্ণ যৌবন। আর নৌকা নিয়ে বিস্তীর্ণ হাওরে ভেসে বেড়ানোর মুখ্যম সময় এই বর্ষাকাল। সারা বছর হাওরের সৌন্দর্য অটুট থাকলেও মূলত বর্ষাকালই ভ্রমণ পিপাসুদের মূল আকর্ষণ। হাওরপ্রেমীদের ভিড় জমে বর্ষায়।
কথিত আছে, বৃহত্তর সিলেট ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের একটি বড় অংশ এক সময় ‘কালীদহ সাগর’ নামে বিশাল জলরাশিতে নিমজ্জিত ছিলো। পরে প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে তা পিরিচ আকৃতির নিম্ন সমতল ভূমিতে পরিণত হয়, এ নিম্ন সমতলভূমিই এখন হাওর। যদিও হাওর শব্দটি সাগর শব্দের অপভ্রংশ। সাগর থেকে সায়র, আর সায়র থেকে হাওর বলে জানা যায়। ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যর কারণে হাওরের সৌন্দর্য অন্যান্য এলাকার চেয়ে একটু ভিন্ন।
হাওরের সৌন্দর্য: হাওরের সৌন্দর্যের কথা বললে প্রথমেই যেটি চিন্তাতে আসে সেটি হলো বিশাল জলরাশির বুকে হিজল আর পানির নিচ থেকে মাথা উঁচু করা করচ বন। হাওরের মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন জনপদগুলো যেনো ভেসে বেড়ায় ডিঙ্গি নৌকার মতো। বিস্তীর্ণ হাওরে ছোট বড় নৌকায় করে জেলেদের মাছ ধরা। হাওর পাড়ে বেড়ে উঠা শিশু, কিশোরদের পানিতে সাতার কাটা, গাছ থেকে লাফিয়ে পড়া আপনাকে নিয়ে যাবে শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলোতে। রাতে হাওরের মাঝখানে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় হারিকেন বা চার্জার বাতির ছোট ছোট আলো দেখলে মনে হবে শত প্রদীপের বহর হাওরের পানিতে ভাসছে। নৌকা বা ট্রলারের মাচায় বসে হাওরের শেষ বিকেলের গোধূলী বেলায় পানিতে পশ্চিম আকাশে ডুবন্ত লাল সূর্যাস্ত আপনার মানসিক প্রশান্তি বাড়িয়ে দিবেই। ভরা পূর্ণিমায় হাওর সাজে তার মায়াবীনি রূপে। মাথার উপর পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে শান্ত নদীতে প্রিয়জনকে সাথে নিয়ে কাটানো একটি রাত হয়ে উঠতে পারে আপনার জীবনের স্মরণীয় একটি রাত।
হাওরের উপজেলাগুলোর দর্শনীয় স্থান ও বিখ্যাত খাবার:
অষ্টগ্রাম: ভাটি বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি অষ্টগ্রাম। হাওর, নদীর মিলনস্থল এই গ্রাম। ইতিহাস, ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি জনপদ অষ্টগ্রাম উপজেলা। জেমস রেনেলের মানচিত্রে অষ্টগ্রামের পূর্ব নাম “আটগাঁও” বলে কথিত। ড. দীনেশ চন্দ্রের ময়মনসিংহ লিটারেরী মানচিত্রে অষ্টগ্রাম নামটি উল্লেখ রয়েছে। ১৯২৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানচিত্রটি প্রকাশ হয়। এই জনপদের নামটি ঠিক কবে থেকে অষ্টগ্রাম বলা হয় তা জানা যায়নি। তবে আটটি গ্রাম নিয়ে গঠিত বলে লোকমুখে আটগাঁও নামটি এখনও বিদ্যমান আছে। নামকরনের দিক দিয়ে জনশ্রুতি রয়েছে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর সাথে আসা আউলিয়াদের মধ্যে আটজন এই এলাকায় এসেছিলেন বলে এর নাম আট আউলিয়ার গ্রাম বা অষ্টগ্রাম করা হয়। খ্রিষ্ট্রীয় দ্বাদশ শতকে বঙ্গাধিপতি বল্লাল সেনের কৌলিন্য প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বল্লাল সেনের অধিসামন্ত অনমত্ম দত্ত অষ্টগ্রামের কাস্তুল নামক স্থানে বসতি স্থাপন করেন। অনমত্ম দত্তের সঙ্গে তার গুরু শ্রী কষ্ঠদ্বিজ এবং অনচরবর্গ এই এলাকায় আসেন। তারা এই এলাকার আটটি গ্রামে বসতি স্থাপন করার পর অষ্টগ্রাম নামের উৎপত্তি হওয়ার জনশ্রুতি আছে। অষ্টগ্রাম থানা সৃষ্টি হয় ১৯১৫ সালে।
এ উপজেলা ভ্রমণের সময় দেখে যেতে পারেন সাড়ে চারশত বছরের পুরোনেরা মুঘল স্থাপত্য ঐতিহাসিক শাহ কুতুব মসজিদ। এছাড়া রয়েছে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট জাহাজ চত্বর, কাস্তুল পাথরের মসজিদ, কাস্তুল ঈশা খাঁ ও মানসিংহ যুদ্ধস্থল, মসজিদজাম ব্রহ্মাণী মন্দির, হাবিলী বাড়ি, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সেতু, অষ্টগ্রাম-বাজিতপুর সড়ক, বড় হাওর সাব মার্সিবল সড়ক, জলডুব হাওরের হিজল বন, মোহনতলা করচ বন ইত্যাদি।
অষ্টগ্রাম ভ্রমণের সময় অবশ্যই অষ্টগ্রামের বিশ্ববিখ্যাত পনির নিতে ভুলবেন না। যারা পনির খেতে ভালোবাসেন তারা অষ্টগ্রামের বিখ্যাত পনির অবশ্যই নিয়ে যেতে পারেন। এছাড়া অষ্টগ্রামের কাস্তুল বাজারের আকাশ ঘোষের রসমালাই মিষ্টান্ন প্রেমীদের মনে জায়গা করে নিয়েছে। অষ্টগ্রামের আরেকটি বিখ্যাত জিনিস রয়েছে সেটি হলো ইকরদিয়া বাজারের বিখ্যাত ১২ ইঞ্চির গুড়ের তৈরী মুরালি। মচমচে গরম গরম এই মুরালি আপনার হাওর ভ্রমণকে আরো মিষ্টি করে তুলবে। এছাড়াও যারা শুটকি মাছ খেতে ভালোবাসেন চাইলে অষ্টগ্রামের বাঁশপাতি ও পুটি মাছের চ্যাপা শুটকি চাইলে পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের জন্য নিয়ে যেতে পারেন। অষ্টগ্রাম বাজারে মাছ মহল এলাকায় গেলেই দেখা মিলবে এই বিখ্যাত চ্যাপা শুটকির।
মিঠামইন: ১৯৮৩ সালের ৭ নভেম্বর মিঠামইন উপজেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। উপজেলায় উন্নিতকরণের ইতিহাস নতুন এবং নিরবচ্ছিন্ন হাওর এলাকা হলেও এটি একটি প্রাচীন জনপদ। জেমস জে. রেনেল অঙ্কিত বাংলার প্রাচীন মানচিত্রেও (১৭৮১) মিঠামইনের কথা উল্লেখ রয়েছে। এলাকাটিতে কেউ মিঠামন, কেউ মিঠামইন, কেউ মিটামইন বা মিটামন বলে উচ্চারণ করে থাকেন। নামের উৎস সম্পর্কে জনশ্রুতি হল, যেটি বর্তমানে উপজেলা সদর সে গ্রামের পাশ্ববর্তী এলাকায় এক সময় প্রচুর খাগড়া বনের সমাবেশ ছিল। উক্ত খাগড়ার ছিল মিষ্টি বা মিঠা রস। এই খাগড়ার বন থেকে মিঠাবন এবং সেখান থেকে মিঠামন বা মিঠামইন হয়েছে। এছাড়াও জনশ্রুতি রয়েছে, এলাকাটিতে এক সময় প্রচুর মইন গাছ ছিল। নদীল ধারে, পতিত জমিতে বা কান্দায় মইন গাছের বিপুল সমারোহ ছিল যা স্থানীয়ভাবে কায়জা নামে পরিচিত ছিল। ইক্ষু গাছের মত উচ্চতা বিশিষ্ট সরু গাছটির ভিতরে মিষ্টি রস ছিল। যারা মইন গাছের রস আস্বাদন করেছেন তারা এখনও স্মৃতিচারণ করে থাকেন। এই মিষ্টি বা মিঠা মইন থেকে মিঠামইন শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকের অভিমত।
এ উপজেলা ভ্রমণের সময় ঘুরে দেখতে পারেন সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বাসভবন, মিঠামইন জিরো পয়েন্ট, দিল্লীর আখড়া, ঘাগড়া মালিকের দরগাহ, নবনির্মিত ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম অল ওয়েদার সড়ক প্রেসিডেন্টে রিসোর্ট, হাওর রিসোর্ট ইত্যাদি।
ইটনা: ইটনা কিশোরগঞ্জ জেলার তথা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রাম এবং অন্যতম বৃহত্তম হাওর উপজেলা। এর একটি বিশাল অংশ জলরাশি। ১৮৬৪ সনে বর্তমান ইটনা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার পশ্চিমদিকে বাদলা গ্রামে একটি আউট-পোষ্ট থানা বা পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপিত হয়েছিল। ১৯০৬ সনের ১৫ই জুন পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকারের ৬৬৭৬ নং গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাদলা পুলিশ ফাঁড়ি বিলুপ্ত করে, ইটনায় পূর্নাঙ্গ থানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইটনা উপজেলার নামকরণ নিয়ে মজার প্রবাদ প্রচলিত আছে। জমির জরিপ চলাকালে কর্মচারীরা জরিপের ইতি ঘোষণা করার পরেও দেখা গেলো এলাকাটি আরো বড়, তাই জরিপের ইতি না। এই ইতিনা অপভ্রংশে ইটনা নামে পরিচিত হয়। তবে অনেকেই এই কাহিনীকে নিছক প্রবাদ মনে করেন।
ইটনা উপজেলা ভ্রমনে দেখে আসতে পারেন জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আনন্দ মোহন বসুর বাড়ি, ধনপুর ইউনিয়নের গুরুদয়াল সরকারের বাড়ি, ইটনা মধ্যগ্রাম জামে মসজিদ (গায়েবী মসজিদ), পাচ পীরের দরগা (মীর্ধা হাটি) ইত্যাদি। এছাড়া ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের বুক চিড়ে নবনির্মিত অলওয়েদার সড়কে কাটানো মুহুর্ত জীবনের স্মরণীয় মুহুর্তে পরিণত হবে। ২৯.৩৭ কিলোমিটারের এই রাস্তা বর্ষায় যে কত সুন্দর তা নিজ চোখে অবলোকন না করলে কিছুতেই বুঝানো সম্ভব নয়।
নিকলী: নিকলী কিশোরগঞ্জ জেলায় প্রাচীন জনপদ। ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার প্রথম প্রকাশিত এবং ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে অংকিত ঐতিহাসিক মেজর জেমস রেনেল এর মানচিত্রে নিকলী জনপদের কথা উল্লেখ আছে। মোগল বাহিনী খাজা ওসমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এবং তাকে ধাবিত করতে এই এলাকায় এসে পৌঁছায় এবং সেখানে ছাউনি ফেলে। তাদের অস্থায়ী আবাসস্থল স্থানীয় মানুষেরা জড়ো হলে দলের প্রধান সিপাহীদের বলেন উছলে নিকালো। এই ফার্সিয় শব্দ ভাষা উচ্চারনের বিবর্তন আর বিকৃতীতে নিকালো থেকে নিকলী হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। অন্যদিকে, নিকলীর সাবেক নাম আগর সুন্দর বলে নানা গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছে। এদিকে নিকলী নিখলী নামের হুবহু শব্দ উচ্চারণ ব্যবহার উল্লেখ রয়েছে বাংলা ভাষার প্রথম প্রাচীন চর্যাপদ নামক কাব্য গ্রন্থে। অনুরূপ প্রাচীন রসুল বিজয় কাব্য গ্রন্থে নিকলী নিকলী নিখলী শব্দ ব্যবহার উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ জনপদ নামে নিকলী নামের সঠিক উতপত্তির কোন সন্ধান না পাওয়া গেলেও নিকলী এ শব্দ নামে দালিলি প্রমাণ পাওয়া যায়।
এ উপজেলা ভ্রমণে যা যা দেখতে পারেন: গুরই শাহী মসজিদ। উপজেলা সদরের সোজা দক্ষিণ দিকে অবস্থিত গুরই ইউনিয়নে অতি প্রাচীন এ মসজিদটি অবস্থিত। স্থাপত্যশৈলীর বিচারে অতি প্রাচীর এ মসজিদটি একটি প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন, এতে কোন সন্দেহ নেই। মসজিদটির দেয়ালগাত্রে স্থাপিত শিলালিপিটির পাঠোদ্ধার করা গেলে এর ইতিহাস জানা যেতেও পারে। এ মসজিদকে ঘিরে এতদঞ্চলে অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে। যেমন অনেকেই বলেন, এটি নাকি গায়েবী মসজিদ। এখনও অনেক মায়েরা তাদের শিশু সন্তানদের মুখে প্রথম ভাত দেয়ার সময় স্বপরিবারে গুরই শাহী মসজিদে যান। এছাড়া হাজী সাহেবের দরগা, দামপাড়া ইউনিয়নের পাহাড় খাঁর ভিটা, হযরত শাহ গুণ জালাল (র:)এর মাজার, ছেত্রা গ্রামের আখড়া, ষাইটধার লাল গোস্বমীর আখড়া, চন্দ্রনাথ গোস্বামীর আখড়া ইত্যাদি।
নিকলী ভ্রমণের সময় যারা মিষ্টি প্রেমী রয়েছেন তারা অবশ্যই দামপাড়া বাজারের রসমলাই খেতে যেতে পারেন।
যেভাবে আসবেন: হাওর উপজেলার সৌন্দর্য উপভোগের উত্তম সময় বর্ষাকাল। হাওর দেখতে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে বাস অথবা ট্রেনে করে সরাসরি কিশোরগঞ্জ বা কুলিয়ারচর, ভৈরব বাজার, বাজিতপুর বা নিকলী আসতে হবে। যদি কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে যেতে চান সেক্ষেত্রে শহরতলীর একরামপুর বা শোলাকিয়া রেলগেইট এলাকা থেকে সিএনজি করে বালিখলা বা চামড়া বন্দর নৌকা ঘাটে যেতে হবে। এক্ষেত্রে জনপ্রতি সিএনজি ভাড়া পড়বে ৬০-৭০ টাকা। নৌকা ঘাট থেকে রিজার্ভ ট্রলার বা মিঠামইন রুটের ট্রলার ধরতে পারেন। যদি সারাদিনের জন্য রিজার্ভ ট্রলার করেন ৫ থেকে ১০ জনের জন্য ছোট নৌকা ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা, ২০ থেকে ৫০ জনের টিম হলে বড় নৌকা সরকারি ছুটির দিন ব্যাতীত ৩০০০ থেকে ৫০০০ টাকায় রিজার্ভ নিতে পারেন। তবে শুক্রবার বা শনিবার দিন হলে পর্যটকদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নৌকা ভাড়া বেড়ে যায়। ছুটির দিনে ছোট নৌকা ৮০০ থেকে ১৫০০, বড় নৌকা ৬০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া চাইবে। দরদাম করে ভাড়া আপনার বাজেট অনুযায়ী তখন নির্ধারণ করে নৌকায় উঠতে পারেন। আর যারা বাজেট ভ্রমণ করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন সেক্ষেত্রে এক ঘন্টা পর পর ৭০ টাকা জনপ্রতি মিঠামইন রুটের নৌকা করে যেতে পারেন। দুই ভাবেই নৌকাতে গেলে বালিখলা থেকে মিঠামইন সোয়া ১ ঘন্টার মতো সময় লাগবে। এছাড়াও যারা বাজেট নিয়ে চিন্তা করেন না সেক্ষেত্রে দ্রুত যেতে চাইলে স্পিডবোটে যেতে পারে। জনপ্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় ১৫ থেকে ২০ মিনিটে মিঠামইনে পৌছাতে পারেন। মিঠামইন নেমে সারদিনের জন্য বা আপনার সময় অনুযায়ী ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা রিজার্ভ নিয়ে হাওর ঘুরে দেখতে পারেন।
এছাড়াও যারা কিশোরগঞ্জ সদর শহরতলী না হয়ে হাওরে যেতে চান সেক্ষেত্রে আপনারা ঢাকা থেকে ট্রেন বা বাসে করে কুলিয়ারচর বা বাজিতপুর হয়ে অষ্টগ্রাম আসতে পারেন। বাসে আসলে প্রথমে ঢাকা গোলাপবাগ বা যাত্রাবাড়ি থেকে কিশোরগঞ্জগামী বাসে করে কুলিয়ারচর দাড়িয়াকান্দি বাসস্ট্যান্ড আসতে হবে। ঢাকা থেকে এগারোসিন্ধুর (প্রভাতী/গোধুলী) বা কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে করে আসলে কুলিয়ারচর স্টেশনে নামতে হবে। পরে জনপ্রতি ২০ থকে ৩০ টাকা করে অটোরিকশা করে কুলিয়ারচর লঞ্চঘাটে এসে লঞ্চ, ট্রলার অথবা স্পিডবোটে অষ্টগ্রাম আসতে পারেন। জনপ্রতি ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা জনপ্রতি লঞ্চ বা ট্রলারে করে আসতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে সময় লাগবে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘন্টা। জনপ্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা করে ৩০ থেকে ৩৫ মিনিটে স্পিডবোটে করেও অষ্টগ্রাম আসতে পারেন। চাইলে রির্জাভ ট্রলারও নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে সারদিনের জন্য ৪০০০ থেকে ৬০০০ টাকায় ট্রলার ভাড়া করতে হবে। অবশ্যই দরদাম করে নিবেন। অষ্টগ্রাম লঞ্চ ঘাট থেকে নেমে সারাদিনের জন্য ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা রিজার্ভ নিয়ে হাওর ঘুরে দেখতে পারেন।
আর যদি ট্রেনে ঢাকা থেকে বাজিতপুর হয়ে আসেন সেক্ষেত্রে বাজিতপুর রেলস্টেশেন নামতে পারেন। আর বাসে করে আসলে ঢাকা থেকে বাজিতপুর গামী বাস ধরে বাজিতপুর বাজারে আসতে হবে। সেক্ষত্রে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা জনপ্রতি বাস ভাড়া পড়বে। রেল স্টেশন থেকে বাজিতপুর নৌকা ঘাট পর্যন্ত ৩০ থেকে ৫০ টাকা ও বাজিতপুর বাজার থেকে জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা ভাড়ায় অটোরিকশায় করে আসতে হবে। সেখান থেকেও রুটের ট্রলারে জনপ্রতি ১০০ থেকে ১২০ টাকা ও রিজার্ভ সারাদিনের জন্য ৩০০০ থেকে ৫০০০ টাকায় নৌকা ভাড়া করে অষ্টগ্রাম আসতে হবে।
যদি নিকলী হাওর ঘুরতে আসেন সেক্ষেত্রে ট্রেনে করে আসলে আপনাকে নামতে হবে গচিহাটা রেলস্টেশন। সেখান থেকে রিজার্ভ সিএনজি অথবা রুটের সিএনজি নিয়ে নিকলী আসতে হবে। ঢাকা থেকে বাসে করে আসলে আপনাকে নামতে হবে কটিয়াদী বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে জনপ্রতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা ভাড়ায় সিএনজিতে করে নিকলী নৌকা ঘাটে আসতে হবে। পরে সেখান থেকে আপনার সময় অনুযায়ী অথবা সারাদিনের জন্য ৩০০০-৬০০০ টাকায় ট্রলার ভাড়া করে হাওর ভ্রমণ করতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন, খাবেনঃ ভ্রমণের চিন্তা মাথায় আসলেই নতুন জায়গায় রাত্রিযাপনের একটা ব্যাপার থাকে। সেক্ষেত্রে হাওরের প্রতিটি উপজেলায়ই জেলা পরিষদ ডাকবাংলো আছে। ৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় ডাকবাংলোগুলোর রুম ভাড়া নিয়ে থাকতে পারেন। ডাক বাংলো গুলোতে রাত্রিযাপন করলে কেয়ারটেকার বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সাথে আগেই যোগাযোগ করে বুকিং দিয়ে রাখবেন। কেয়ারটেকারের সাথে যোগাযোগ করলে খাবারের ব্যবস্থাও উনিই করবেন।
অষ্টগ্রাম উপজেলা পরিষদ ডাক ডাকবাংলোর বর্তমান কেয়ারটেকারের ফোন নম্বর: ০১৯১৪-৯৭৫৩৮৯।
ইটনা উপজেলা পরিষদ ডাক ডাকবাংলোর বর্তমান কেয়ারটেকারের ফোন নম্বর: ০১৭৯০-২৬৩৫৩৮।
মিঠামইন উপজেলা পরিষদ ডাক ডাকবাংলোর বর্তমান কেয়ারটেকারের ফোন নম্বর: ০১৯৩৫-৬২৬৮৫২।
নিকলী উপজেলা পরিষদ ডাক ডাকবাংলোর বর্তমান কেয়ারটেকারের ফোন নম্বর: ০১৯৮২-৫২২৮২১।
এছাড়াও এ উপজেলাগুলোর বাজারগুলোতে থাকার মতো ভালো মানের কিছু রিসোর্ট ও আবাসিক হোটেল রয়েছে। সেক্ষেত্রে হোটেল ও রিসোর্টের মান অনুযায়ী রুম ভাড়া নিয়ে রাত্রিযাপন করতে পারেন। যারা বাজেট ট্যুর করেন সেক্ষত্রে ৬০০ থেকে ১২০০ টাকার ভিতেরেও রুম ভাড়া নিতে পারেন। তবে সরকারি ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকদের চাপ থাকায় ভাড়া তুলনামূলক বেড়ে যায়।
খাবার খেতে চাইলে স্থানীয় বাজার গুলোতে রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এসব রেস্টুরেন্টে হাওরের তাজা মাছ, মাংস ও সবজি দিয়ে আহার সেরে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে জনপ্রতি ২০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে ভালো প্যাকেজে খাবার খেতে পারবেন। এছাড়াও যদি নৌকাতে রাত্রিযাপন করেন নৌকার মাঝি বা চালককে আগে থেকেই জানিয়ে রাখবেন সেক্ষেত্রে মাঝি বা নৌকার লোক সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবে।
হাওর ভ্রমণে কিছু পরামর্শ: হাওর ভ্রমণে কিছু সতর্কতা অবশ্যই পালন করবেন। বর্ষাকালে হাওর ভ্রমণে আগে থেকেই আবহাওয়া পরিস্থিতি জেনে ভ্রমনের দিন, তারিখ ঠিক করুন। বর্ষা মৌসুমে হাওর ভ্রমণে সাথে ছাতা রাখুন। ভ্রমণের সময় লাইফ জ্যাকেট বা জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম. বিশুদ্ধ পানি, খাবার, টর্চলাইট, লাইটার ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সাথে রাখুন।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু টিপস: যদি আপনি সাতার না জানেন সেক্ষেত্রে অবশ্যই সাথে লাইফ জ্যাকেট বা জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম সাথে রাখবেন। হাওরে যত্রতত্র পানিতে নামবেন না। হাওরে বর্ষা মৌসুমে পানি চলমান থাকে তাই ¯্রােতের বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখবেন। যেখানে তুলনামূলক ¯্রােত কম সেখানে নামার চেষ্টা করবেন। আবেগের বশে সাতরিয়ে দূরে যাবেন না। ভারী পোশাক পড়ে পানিতে নামবেন না। হাওর যেহেতু চাষাবাদের এলাকা সেহেতু পানির নিচে অধিকাংশই জমি। নৌডুবি বা দূর্ঘটনাবশত পানিতে পড়ে গেলে মাথা ঠান্ডা রেখে চিন্তা করুন। অযথা সাতরানোর চেষ্টা করবেন না। পানিতে নিজের শক্তি খরচ না করে পানির শক্তিকে কাজ লাগানোর চেষ্টা করুন। সাতার জানা থাকলে পানির স্রোতের অবস্থা বুঝে নিজেকে স্রোতের সাথে ভাসিয়ে নিন। স্রোতের বিপরীতে সাতরিয়ে ক্লান্ত হলেই বিপদ। হাওরে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ পানিতে দেখা যায়। জলজ উদ্ভিদ দেখলেই দুই পা সোজা করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবেন। আগেই বলেছি হাওর যেহেতু চাষাবাদের এলাকা প্রায় জায়গাতেই দাঁড়াতে পারবেন। পায়ের তলায় মাটির উপস্থিতি পেলে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকুন সেক্ষেত্রে আপনার জীবন রক্ষা পেতে পারে। হাওরে অধিকাংশই যারা প্রাণ হারান তাদের অনেকই এসব টেকনিক সম্পর্কে জানেন না। আপনার একটু বুদ্ধিমত্তাই আপনাকে রক্ষা করতে পারে। আর যারা সাতার জানেন না তারা হাওরের পানিতে নামা থেকে বিরত থকুন।
হাওরে বর্ষায় আবহাওয়া পরিবর্তনশীল। হাওরে বাতাস থাকলে ঢেউয়ের পরিমাণ বেড়ে যায় সেক্ষেত্রে আপনার নৌযানে যারা আরোহন করবেন তারা নৌযানের ভারসাম্য রক্ষা করে বসুন। ঢেউ দেখলে সবাই এক জায়গায় জড়ো হবেন না। নৌযানের দুই পাশ মিলিয়ে বসার চেষ্টা করুন। আর অবশ্যই নৌযানে পর্যাপ্ত জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম আছে কি না তা নিশ্চিত করে নৌযানে আরোহন করবেন। হাওর ভ্রমণের আগে যে উপজেলাতে যাবেন সেখানকার ফায়ারসার্ভিস অথবা নিকটস্থ থানার ফোন নম্বর সংগ্রহ করে ফোনে সংরক্ষণ করে রাখুন। যে কোনো দূর্ঘটনা পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে মাথা ঠান্ডা রেখে তাদের সাথে যোগাযোগ করে নৌযানের চালকের সহায়তা নিয়ে আপনার বর্তমান অবস্থান নিশ্চিত করে তাদের অবহিত করুন।
বিরুপ আবহাওয়াতে হাওরে বজ্রপাতের পরিমান বেড়ে যায়। বজ্রপাতের সময় নৌযানের ছাদে বসা থাকলে নৌযানের ভিতরে প্রবেশ করুন। যতটুকু সম্ভব শুকনো জায়গা দেখে অবস্থান নিন। যদি খোলা যায়গায় থাকেন সেক্ষেত্রে আপনার নিকটস্থ নিরাপদ স্থান খুজে সেখানে আশ্রয় নিন। আশেপাশে কোনো ভবন বা লোকালয় থাকলে সেখানে অবস্থান করার চেষ্টা করুন।
জরুরী মুহুর্তে যোগাযোগ করুন; হাওর ভ্রমণের সময় যেকোনো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতে পড়তে পারেন। এমন পরিস্থিতি এড়াতে আপনার ফোনবুকে এই নম্বরগুলো সংরক্ষণ করতে পারেন। অষ্টগ্রাম থানার অফিসার ইনচার্জের নম্বর: ০১৩২০-০৯৫৭০৩; অষ্টগ্রাম উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের নম্বর: ০১৮১০-৬৯৬৭৬৭। মিঠামইন থানার অফিসার ইনচার্জের নম্বর: ০১৩২০-০৯৫৬৫১; মিঠামইন উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের নম্বর: ০১৯১৪-৫৬৬৪৬৬। ইটনা থানার অফিসার ইনচার্জের নম্বর: ০১৩২০-০৯৫৬২৫; ইটনা উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের নম্বর: ০১৯২২-৮২৮৫৮৬। নিকলী থানার অফিসার ইনচার্জের নম্বর: ০১৩২০-০৯৫৬৭৭; নিকলী উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের নম্বর: ০১৭০৫-৫০৫০১৩। কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জের নম্বর: ০১৩২০-০৯৫৫৭৩; কুলিয়ারচর উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের নম্বর: ০১৭৩০-০৮২২১৭। বাজিতপুর থানার অফিসার ইনচার্জের নম্বর: ০১৩২০-০৯৫৫৪৭; বাজিতপুর উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের নম্বর: ০১৭২৫-৭৭১৭৯৫।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বর্ষায় আপনার যান্ত্রিক জীবনে ক্লান্তি বা অবসাদ দূর করতে কিশোরগঞ্জের হাওর ভ্রমণ হতে পারে আপনার সহজ সমাধান। বর্ষার মেঘলা আকাশ, হাওরে সূর্যাস্ত, রাতের ভরা জ্যোৎস্না, নৌকায় বসে বৃষ্টি বিলাস এসবের দেখা মিলবে শুধুই হাওরে। ফেলে আসা শৈশবের এক একটি মুহুর্ত ফিরে পেতে এ ভরা বর্ষায় অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, ইটনা বা নিকলীর হাওর ভ্রমণের সুযোগ কেনোই বা হাতছাড়া করতে যাবেন।